• সোমবার, ১৩ মে ২০২৪, ৩০ বৈশাখ ১৪২৯

জাতীয়

কুসিকে সূচনা অভিষেক মসিকে আস্থা টিটুতে

  • প্রকাশিত ১০ মার্চ ২০২৪

নিজস্ব প্রতিবেদক:

সংঘাত-সহিংসতা ও অভিযোগ পাল্টা অভিযোগে শেষ হয়েছে কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের (কুসিক) মেয়র পদে উপনির্বাচন। অপরদিকে বড় কোনো গোলযোগ না হলেও ইভিএম বিড়ম্বনায় পড়তে হয়েছে ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনের (মসিক) ভোটারদের। গতকাল সকাল আটটা থেকে বিকাল চারটা পর্যন্ত এই দুই সিটির ভোটগ্রহণ চলে। দিনভর ইভিএমে ভোট শেষে সন্ধ্যায় ফলাফল ঘোষণা করেন সংশ্লিষ্ট রিটার্নিং কর্মকর্তারা।

কুসিক নির্বাচনে বেসরকারিভাবে বিজয়ী হয়েছেন মহানগর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক তাহসীন বাহার সূচনা। ১০৫টি কেন্দ্রের সবকটিতে বাস প্রতীকে সূচনা পেয়েছেন ৪৮ হাজার ৮৯০ ভোট। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী সাবেক মেয়র ও বিএনপির বহিষ্কৃত নেতা মনিরুল হক সাক্কু। টেবিল ঘড়ি প্রতীকে তিনি পেয়েছেন ২৬ হাজার ৮৯৭ ভোট। সূচনা মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সদর আসনের সংসদ সদস্য আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহারের কন্যা।

অপরদিকে ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনে (মসিক) মেয়র পদে বেসরকারিভাবে বিজয়ী হয়েছেন সদ্য সাবেক মেয়র ও মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি ইকরামুল হক (ঘড়ি)।
তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী জেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা সাদেকুল হক খান (হাতি) পেয়েছেন ৬ হাজার ৬৫৬ ভোট। এছাড়া জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এহতেসামুল আলম (ঘোড়া) পেয়েছেন ২ হাজার ২৩৩ ভোট।

এর আগে কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের মেয়র পদে উপ-নির্বাচনে ভোটগ্রহণ শুরু হওয়ার পর ভোটকেন্দ্রের বাইরে গোলাগুলি, প্রতিপক্ষের এজেন্টদের ওপর হামলা এবং ভোটারদের কেন্দ্রে যেতে বাধার অভিযোগ পাওয়া যায়। অপরদিকে ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনে (মসিক) ইভিএমে ভোট দিতে ভোগান্তির মধ্যে পড়েছেন ভোটারা।
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের দুই মাস পর গতকাল বড় পরিসরে স্থানীয় সরকারের প্রথম ভোট হলো। ময়মনসিংহে মেয়র পদে প্রার্থী হওয়া পাঁচজনের মধ্যে চারজনই আওয়ামী লীগের। এর বাইরে জাতীয় পার্টির প্রার্থী দলীয় প্রতীকে নির্বাচনে অংশ নেন।

কুমিল্লায় চার প্রার্থীর মধ্যে দুজনই আওয়ামী লীগের। ভোট বর্জন করা বিএনপির দুই বহিষ্কৃত নেতাও স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ভোটের লড়াইয়ে ছিলেন। তবে এই সিটিতে দলীয় প্রতীকে কোনো প্রার্থী ছিল না।

গতকাল সকাল আটটায় কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের (কুসিক) মেয়র পদে ভোটগ্রহণ শুরু হয়। ভোট শুরুর দেড় ঘণ্টার মধ্যে উত্তেজনা দেখা দেয়। গোলাগুলি, ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে আসতে বাধা এবং বিভিন্ন কেন্দ্র থেকে এজেন্টদের বের করে দেওয়ার অভিযোগ পাওয়া যায়।

সকাল ১০টার দিকে নগরীর ১৯ নম্বর ওয়ার্ডের নেউরা এলাকায় মুন্সী এম আলী উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রের বাইরে দুই পক্ষের গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। এতে দুজন গুলিবিদ্ধ হয়েছেন, আহত হয়েছেন আরও দুজন। আহতরা ঘোড়া প্রতীকের প্রার্থী নিজাম উদ্দিন কায়সারের সমর্থক বলে জানা গেছে।

এ ব্যাপারে নিজাম উদ্দিন কায়সার বলেন, ‘বাস প্রতীকের প্রার্থী তাহসিন বাহার সূচনার সমর্থকরা ভোটারদের কেন্দ্রে আসতে দিচ্ছে না। বিভিন্ন স্থানে তারা আমার সমর্থকদের ওপর হামলা করেছে। ১৯ নম্বর ওয়ার্ডের নেউরা মুন্সী এম আলী উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে গুলিবিদ্ধ হয়েছে আমার কর্মীরা। তাদের হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।’

স্থানীয় ভোটার শহীদুল হক স্বপন বলেন, ‘আমাদের কেন্দ্রে শান্তিপূর্ণ ভোট হচ্ছিল। কিছু বহিরাগত এসে সারিবদ্ধ ভোটার লাইনে হামলা করে। ঘড়ি ও ঘোড়া প্রতীকের এজেন্টদের বের করে দেয়। এ সময় তাদের হামলায় তিনজন ভোটার আহত হয়েছেন।’

প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেন, কুমিল্লা নগরীর ১৯ নম্বর ওয়ার্ডের মুন্সী এম আলী উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রের পাশেই ঘোড়া প্রতীকের সমর্থক জহিরুল আহমেদ ও তুহিন নামের এক ব্যক্তিকে মহানগর ছাত্রলীগ নেতা সুমন গুলি করে। আহত জহিরুল ও তুহিনকে স্থানীয়দের সহযোগিতায় কুমিল্লা মেডিকেল কলেজে নেওয়া হয়েছে।

আহত জহির বলেন, ‘ভোটকেন্দ্রের পাশে আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম, এ সময় বাস মার্কার সমর্থক মহানগর ছাত্রলীগ নেতা সুজন আমাকে ও তুহিনকে পুলিশের সামনেই গুলি করে।’
মেয়র প্রার্থী মনিরুল হক সাক্কু বলেন, আমার প্রতিদ্বন্দ্বী বাস প্রতীকের সমর্থকরা ভোটারদের কেন্দ্রে আসতে দিচ্ছে না। রাতে বাড়ি বাড়ি গিয়ে হুমকি দেওয়া হয়েছে। সকাল থেকেই পথে পথে পাহারা বসানো হয়েছে যেন আমার ভোটাররা কেন্দ্রে না আসতে পারে। তিনি আরও বলেন, নির্বাচন কমিশনের কাছে বারবার অভিযোগ দিয়েছি। কিন্তু কোনো কাজ হয়নি। তিনটা ওয়ার্ডে আমার কোনো এজেন্টকে ঢুকতেও দেওয়া হয়নি। ভোটের পরিবেশ একদম ভালো নয়।

আরেক মেয়র প্রার্থী মহানগর আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা নূর উর রহমান মাহমুদ তানিম বলেন, বিভিন্ন কেন্দ্রে এজেন্ট ঢুকতে দেওয়া হয়নি। অনেক কেন্দ্র থেকে আমার এজেন্ট বের করে দেওয়া হয়েছে। এছাড়া ২৬ নম্বর ওয়ার্ডে আমার ভোটারদের মারধর করা হয়েছে। ভোটকেন্দ্রে আসা ভোটারদের গতিরোধ করে বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এসব বিষয় হস্তক্ষেপর জন্য রিটার্নিং কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্ট কর্তা ব্যক্তিদের প্রতি অনুরোধ জানানো হয়েছে।

কুমিল্লা সরকারি ভিক্টোরিয়া কলেজ কেন্দ্রে নিজের ভোট দিতে এসে অভিযোগের বিষয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন বাস প্রতীকের প্রার্থী মহানগর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক তাহসীন বাহার সূচনা। তিনি কুমিল্লা সদরের এমপি আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহারের মেয়ে। অভিযোগ ভিত্তিহীন দাবি করে সূচনা বলেন, ‘আমি সকাল থেকে খোঁজ নিয়েছি। সব কেন্দ্রে সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণভাবে ভোট হচ্ছে।’

ময়মনসিংহে ইভিএম বিড়ম্বনা : ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনে বড় কোনো গোলযোগের খবর না এলেও ইভিএমে ভোটগ্রহণের গতি কিছুটা ধীর হওয়ায় এবং অনেকের আঙুলের ছাপ না মেলায় ভোগান্তিতে পড়তে হয় ভোটারদের। বেশির ভাগ বয়স্ক নারীরা এমন সমস্যায় পড়েছে।

সকাল ৮টায় ভোটকেন্দ্রের সামনে লাইনে দাঁড়িয়ে পৌনে ১০টার দিকে কেন্দ্র থেকে বেরিয়ে যান এসকে হাসপাতাল এলাকার বাসিন্দা লাইলী বেগম। তিনি বলেন, ভোট দিতে সকালে কেন্দ্রে লাইনে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু ভোট দিতে গিয়ে দেখি আঙুলের ছাপ উঠে না। এমন অবস্থা হবে জানলে ভোটই দিতে আসতাম না।

এদিকে কালীবাড়ি গুদারাঘাট এলাকার বাসিন্দা মনোয়ারা খাতুন বলেন, ‘আমাদের কামের হাত। পেঁয়াজ কাইট্টা আঙুলের দাগ মুইচ্ছা গেছে। অহন ভোট দেওয়ার আইস্যা বিপদে পড়ছি। আঙুলের ছাপ আসে না। পরে কইছে আইডি কার্ড লইয়্যা আইতে।’

প্রিমিয়ার আইডিয়াল স্কুল কেন্দ্রে ভোট দিতে যান কালিবাড়ী এলাকার বাসিন্দা শেফালী বলেন, ভোট দিতে গিয়ে বিড়ম্বনায় পড়তে হয়। মেশিনে আঙুলের ছাপ উঠেনি।
এ বিষয়ে কেন্দ্রের প্রিজাইডিং অফিসার নূরুল ইসলাম বলেন, নারীদের আঙুলের রেখায় সমস্যা হওয়ায় এমনটি হয়েছে। তবে পুরুষদের ক্ষেত্রে সমস্যা কম। ইভিএমে ভোটে কিছুটা ধীরগতি হচ্ছে। এদিকে অনেক নারীর আঙুলের ছাপ ঠিকমতো না ওঠায় তারা ভোট দিতে সমস্যায় পড়েন। জাতীয় পরিচয়পত্র এনে তাদের ভোট দিতে বলা হয়েছে।

প্রিমিয়ার আইডিয়াল হাইস্কুল নারী কেন্দ্রে ভোট দিতে আসা ৮২ বছর বয়সী লায়লী বেগম দীর্ঘক্ষণ চেষ্টার পরও ভোট দিতে না পেরে সকাল সাড়ে ৯টার দিকে ভোটকক্ষ থেকে বেরিয়ে আসেন।
হতাশা ভরা কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘আর কয়টা দিন বাঁচি কওন যায় না। এই জীবনে আর ভোট দিতাম পারি কিনা জানি না। মনডা বেশি খারাপ অইয়া গেছে।’

তার মতো আরও অনেকেই ভোট দিতে না পেরে ফিরে যেতে দেখা যায়। প্রিমিয়ার আইডিয়াল হাইস্কুল নারী ভোটকেন্দ্রটির প্রিজাইডিং কর্মকর্তা নুরুল ইসলাম বলেন, ‘ইভিএম মেশিন ঠিক আছে। অনেকের আঙুলে ময়লা, কাজ করার কারণে হাতের রেখায় পরিবর্তন হয়। এসব কারণে এরকম হচ্ছে।’ ইভিএমে ভোটগ্রহণের গতি কিছুটা ধীর হলেও ভোটের পরিবেশ নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন মেয়র প্রার্থী মো. ইকরামুল হক টিটু। তিনি বলেছেন, ‘ভোটারদের ব্যাপক সাড়া রয়েছে। তবে ইভিএমে ভোট দিতে ধীরগতি হচ্ছে।’

সাবেক মেয়র ও মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি টিটু ভোটে প্রভাব খাটানোর অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘হাতি প্রতীকের প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী শহর আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট সাদেকুল হক খান মিল্কীর এ ধরনের অভিযোগ ভিত্তিহীন।’

২০১১ সালে কুমিল্লা সিটি করপোরেশন হওয়ার পর দুই দফায় মেয়র ছিলেন বিএনপি নেতা মনিরুল হক। ২০২২ সালের নির্বাচনে তাঁকে হারিয়ে মেয়র নির্বাচিত হয়েছিলেন আওয়ামী লীগের নেতা আরফানুল হক। আরফানুল হক গত বছর ডিসেম্বরে মারা যাওয়ায় এই সিটি করপোরেশনে মেয়র পদে উপনির্বাচন হলো।

উপনির্বাচনে কুমিল্লা মহানগর আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা ও কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের সাবেক ভিপি নূর-উর রহমান মাহমুদও প্রার্থী হয়েছিলেন। তিনি হাতি প্রতীকে পেয়েছেন ৫ হাজার ১৭৩ ভোট। এ ছাড়া কুমিল্লা মহানগর স্বেচ্ছাসেবক দলের সাবেক সভাপতি নিজাম উদ্দিনও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। তিনি ঘোড়া প্রতীকে পেয়েছেন ১৩ হাজার ১৫৫ ভোট।

কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ভোটার ছিলেন ২ লাখ ৪২ হাজার ৪৫৮ জন। ভোটকেন্দ্র ১০৫টি। এই সিটি করপোরেশনে এবারও ভোট গ্রহণ হয়েছে ইভিএমের মাধ্যমে। এই উপ-নির্বাচনে ভোট পড়েছে ৩৮ দশমিক ৮২ শতাংশ। ২০১৮ সালে ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশন প্রতিষ্ঠার পর বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় প্রথম মেয়র হন ইকরামুল হক টিটু। তবে এবার তিনি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন তিন প্রার্থীর সঙ্গে।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads